অর্জুনকে শোক থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করে কৃষ্ণ গীতার সূচনা করেন – “জীবিত বা মৃত, কারোর জন্য অশ্রুপাত করনা” (ভ. গী. ২.১১)। এবং তিনি গীতার পরিসমাপ্তিও করেন অর্জুনকে শোক থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ ক’রে – “আমার উপর বিশ্বাস রাখ। আমি তোমাকে মোক্ষ প্রদান করব। তুমি কেঁদো না” (ভ. গী. ১৮.৬৬)। ক্রন্দন থেকে বিরত থাকার এই দুটি মন্ত্রণার মাঝেই তিনি গীতার সমস্ত শিক্ষাদান করেন। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁর নিজের জীবনে কি কখনও অশ্রুপাত করেছেন ? মহাভারতের সমস্ত মহান...
গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে, কৃষ্ণ যেসব বিভিন্ন গুণাবলীর বর্ণনা দেন, সে সকলই প্রকৃত গুণের পরিচায়ক (ভ. গী. ১৩.৭-১১)। অমানিত্বমদম্ভিত্বং অহিংসা ক্ষান্তিরার্জবম্ | আচার্যোপাসনং শৌচং স্থৈর্যমাত্মবিনিগ্রহঃ |৭| ইন্দ্রিযার্থেষু বৈরাগ্যং অনহঙ্কার এব চ | জন্মমৃত্যুজরাব্যাধি দুঃখদোষানুদর্শনম্ |৮| অসক্তিরনভিষ্বঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু | নিত্যং চ সমচিত্তত্বং ইষ্টানিষ্টোপপত্তিষু |৯| মযি চানন্যযোগেন ভক্তিরব্যভিচারিণী | বিবিক্তদেশসেবিত্বং অরতির্জনসংসদি |১০|...
গীতায় কৃষ্ণ একজন “স্থিতপ্রজ্ঞ” ব্যক্তি হয়ে ওঠার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার অবতারণা করেছেন, অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি যিনি বিচার-বিবেচনাপূর্ণ এবং অবিচলিত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। তিনি বলেন, “যিনি স্বার্থপরতা বর্জন করে শুধুমাত্র সত্যের স্বরূপেই পরিতৃপ্তি লাভ করেন, তিনিই ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ “(ভ. গী. ২.৫৫)। অন্যভাবে বলা যায়, তিনি অর্জুনকে ‘দেহাভিমান’ ত্যাগ করতে বলছেন, যার অর্থ সেইপ্রকার মনোভাব, যখন জীবনের প্রতি নিবদ্ধ দৃষ্টি একরকম দেহ ও বস্তুভিত্তিক ঘোরের...
বাগ্মিতা, সততা, বুদ্ধিমত্তা, বৈদগ্ধ্য অথবা প্রত্যুতপন্নমতিত্ব – একজন প্রকৃত কূটনীতিজ্ঞের সকল গুণই কৃষ্ণের মধ্যে উপস্থিত ছিল। তাঁকে একজন মৃদুভাষী রূপে কল্পনা করা যায়। তাঁর বাণী একাধারে সৎ এবং চিত্তগ্রাহী (ভ. গী. ১৭.১৫)। তাঁর বাণী কখনও ভ্রান্ত নয়, বরং অতি বাস্তবিক। তিনি কখনও প্রতিজ্ঞাবিস্মৃত হননি, কখনও প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করেননি। আবার, ধর্মরক্ষার্থে শত প্রতিজ্ঞা পরিত্যাগ করতেও পিছপা নন। কৃষ্ণের ‘ধর্মদৃষ্টি’-তেই (সামগ্রিক সদগুণ উপলব্ধি করার দূরদর্শিতা)...
অগ্নিষোমীয় ব্যুহ হল সৃষ্টির কাঠামো, এক অনন্ত বিন্যাস। ভক্ষক-ভক্ষিতের সম্পর্ককে বেঁধে রাখার এক চিরন্তন প্রতিষ্ঠান। এই বিষয়টি উপনিষদ এবং যোগবাসিষ্ঠে আলোচিত হয়েছে। গীতায় কৃষ্ণ এই বিষয়টি সম্পর্কে বলেন যখন তিনি চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, শক্তি, প্রাণরস, চিন্তা ইত্যাদির সাথে নিজেকে অভিন্ন রূপে বর্ণনা করেন (ভ. গী. ১৫.১২-১৫)। ‘অগ্নি’ যেখানে ভক্ষকের প্রতীক, ‘সোম’ সেখানে ভক্ষিতের। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অগ্নির জন্য উপযুক্ত পরিমাণে সোমের প্রয়োজন। কৃষ্ণ নিজের...
কৃষ্ণ যখন অনাসক্তি এবং তৃপ্তি নামক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রশস্তি করেন, তখন তিনি কঠোর পরিশ্রমের উপরেও গুরুত্ব আরোপ করেন। স্ববিরোধী যৌক্তিকতার ঝুঁকি নিয়েও কৃষ্ণ গীতায় বলেন, আমি সমস্ত কিছুই লাভ করেছি, তথাপি আমি কর্মে রত (ভ. গী. ৩.২২)। আমি যদি অক্লান্ত কর্মে অসমর্থ হই, তাহলে এই উদাহরণ অনুসরণ করে মনুষ্যজাতি অচলাবস্থায় স্থিত হবে (ভ. গী. ৩.২৩)। যদি আমি কর্ম না করি, তাহলে এই পৃথিবী ধ্বংস হবে, এবং এই অনাসৃষ্টির জন্য দায়ী থাকব আমি (ভ. গী. ৩.২৪)। তাঁর একথা বলার...
ভাগবত পুরাণে কৃষ্ণের প্রাসাদে কুচেলার আগমন নিয়ে একটি মর্মস্পর্শী অধ্যায় আছে। সান্দীপনীর গুরুকুলে কৃষ্ণ এবং কুচেলা সহপাঠী ছিলেন। যখন কৃষ্ণ রাজার ন্যায় জীবনযাপন করছেন, তখন কুচেলা অত্যন্ত দারিদ্রের মধ্যে। কুচেলা কতকটা সাহায্যপ্রার্থী হয়েই পুরাতন বন্ধু কৃষ্ণের কাছে এসেছিলেন, কিন্তু যখন তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হলেন, তখন আর সেকথা বলতে পারলেননা। কৃষ্ণ কোনও প্রতিদানের আশা ব্যতীতই কুচেলাকে অনেক কিছু দান করেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে, তাঁর মত একজন...
গীতায় কৃষ্ণকে প্রায়শই ভক্তি সম্বন্ধে কথা বলতে লক্ষ্য করা যায়। তিনি যতদূর বলেন - যে রূপে চাও সেই রূপে আন্তরিকভাবে ঈশ্বরের উপাসনা কর ; তোমার বিশ্বাসকে আমি শক্তিপ্রদান করব (ভ.গী. ৭.২১)। কিন্তু একথা কি কৃষ্ণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ? তিনি কি একজন ভক্ত? নাকি একজন দাম্ভিক দেবতা? মাতাপিতা, গুরুজন, শিক্ষক এবং জ্ঞানীর প্রতি কৃষ্ণের ভক্তি ও আনুগত্য লক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনি যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞকালে উপস্থিত সকল ঋষির চরণধৌত করেছিলেন (ম. ভা. ২.৩০-৩২...
গীতার মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্জুনকে যুদ্ধে সম্মত করিয়ে শত্রুনিধন। কৃষ্ণ তাঁর বাক্যে কোনরকম জড়তা না রেখে অর্জুনকে অগ্রসর হয়ে প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হওয়ার কথা বলেন। অর্জুনের মনে এই প্রত্যয় আনয়নের পথে তিনি নানাবিধ যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন (ভ. গী. ২.৩১-৩৩, ১১.৩৪)। কিন্তু এগুলি কোনও শূন্যগর্ভ উপদেশাবলী নয়। কৃষ্ণ নিজেও প্রচুর প্রাণনাশ করেছেন। তিনি নিজেও নিজেরই আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করেছেন। তিনি নিজের মাতুল কংসকে বধ করেছেন কারণ কংস একজন ধর্মভ্রষ্ট অত্যাচারী...
গীতায় কৃষ্ণ শান্তিলাভ করার নিমিত্ত এক অশ্রুতপূর্ব সূত্র প্রদান করেন। তিনি বলেন যে, যখন কোনও ব্যক্তি কামনার ঊর্দ্ধে গিয়ে, আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ ক’রে, অহং এবং অধিকারবোধ বর্জন ক’রে জীবন অতিবাহিত করেন, তখনই সেই ব্যক্তি প্রকৃত শান্তিলাভ করেন (ভ. গী. ২.৭১)। কৃষ্ণ নিজজীবনে শান্তিলাভের জন্য অবিকল এই পন্থাই অনুসরণ করেছেন। কৃষ্ণ ব্যক্তিগত লাভ, কামনা ও আকাঙ্ক্ষা বর্জিত এক জীবন কাটিয়েছেন। কখনও কোনও বস্তুবিশেষ, ক্ষমতা, পদ বা খ্যাতির অন্বেষণ করেননি। কখনও লাভের...